গত ২০ অক্টোবর লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর ১৩ বছর পূর্ণ হলো। ২০১১ সালের এই দিনে নিজের জন্মস্থান সির্তে শহর থেকে পালানোর সময় তিনি নিহত হয়েছিলেন। শহরটি বিদ্রোহীরা ঘিরে ফেলেছিল। তারা প্রবল আক্রমণ করছিল। পাশাপাশি ন্যাটো বিমান থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ করছিল।ওই সময় শহরটিতে ঢোকা কঠিন ছিল। সেখান থেকে বের হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কারণ, গাদ্দাফিকে খুঁজতে তখন সবখানে তল্লাশি চলছিল। পরাশক্তি ড্রোন দিয়ে তাঁকে খুঁজছিল।
গাদ্দাফি নিহত হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর দেহরক্ষী মোহাম্মাদ খলিফা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পর খলিফা মিসরে পালিয়ে যান। তিনি এখন সেখানেই বসবাস করছেন। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়, গাদ্দাফি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা ২০১১ সালের জুন মাসের শুরুতে ত্রিপোলি থেকে সির্তে শহরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বহুল প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে মোহাম্মাদ খলিফা বলেছেন, আসলে গাদ্দাফি সির্তে পৌঁছান ওই বছরের ২৩ আগস্ট।সির্তে শহরের ফ্রিল্যান্স ব্যবসায়ী ফারাজ ইব্রাহিম ওই দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা গাদ্দাফির পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। ওই সময় তাঁর দুই ভাই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। তিনি ভাইদের শোকে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। এ রকম সময় একদিন ভোরে তাঁর এক পরিচিত লোক এসে তাঁকে তাঁর সঙ্গে যেতে বলেন। তিনি ওই ব্যক্তির সঙ্গে রওনা হন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ফারাজ বলেন, তাঁকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনটির তৃতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাটে নেওয়ার পর তিনি দেখেন সেখানে স্বয়ং গাদ্দাফি বসে আছেন। ফারাজ উত্তেজিত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমি আমার নেতাকে চোখের সামনে এবং নিরাপদ দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম।’ এটি ছিল ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট, অর্থাৎ গাদ্দাফি নিহত হওয়ার প্রায় দুই মাস আগের ঘটনা।ওই বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে ফারাজের আপন ৪ ভাই এবং তাঁর ১৫ জন আত্মীয়স্বজন ‘লিবিয়া ও শহীদ গাদ্দাফির’ পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।ফারাজের দুই ধরনের ভূমিকা ছিল। প্রথমত, সির্তে ও বানি ওয়ালিদে যোদ্ধাদের কাছে গাদ্দাফির নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া; দ্বিতীয়ত, সরকারি বাহিনীর খাবার, জ্বালানি, ওষুধসহ জরুরি জিনিসপত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করা।গাদ্দাফির পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকা এবং আজও তাঁকে সমর্থন করা হাজার হাজার মানুষের মতো ফারাজ তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য কোনো অনুশোচনা বোধ করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি যা করেছেন, তা ‘ন্যাটো এবং বিদ্রোহীদের হাত থেকে লিবিয়াকে রক্ষা করার জন্য’ করেছেন।
ফারাজের মতো মানুষের লিবিয়ার প্রতি গভীর টান এবং বহিরাগত ন্যাটোর আক্রমণ প্রত্যাখ্যানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিলে গাদ্দাফির প্রতি তাঁদের এই স্তরের আনুগত্য এবং চূড়ান্ত ত্যাগস্বীকারের বিষয়টি সহজে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা যাবে না।
কায়রোতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনের জীবন বেছে নেওয়া ফারাজ আমাকে ফোনে এ কথা বলেছেন। কায়রোতে পৌঁছানোর আগে তিনি মিসরাতায় বিদ্রোহীদের হাতে ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বন্দী ছিলেন। সেখানে বিদ্রোহীদের হাতে তিনি চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।মূলধারার মিডিয়ায় গাদ্দাফিকে একজন নির্মম স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয়, অচিরেই তাঁর নাম কেউ মনেও রাখবে না। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। এ বছর বনু ওয়ালিদে বিপ্লব দিবস উদ্যাপনের র্যালিতে গাদ্দাফির মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে গাদ্দাফির মতো পোশাক পরে একটি খোলা জিপে দেখা যায়। তাঁকে ঘিরে জনতার উল্লাস দেখা যায়।আসলে মৃত্যুর ১৩ বছর পরেও গাদ্দাফি লিবিয়ায় একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে গেছেন। অনেকের মতে, তিনি দেশটির বিভক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ।এই প্রয়াত নেতার প্রতি যে সমর্থন আজও টিকে আছে, তা প্রতিবছরের ১ সেপ্টেম্বর বোঝা যায়। ১৯৬৯ সালের এই দিনে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। দিনটি আজও গাদ্দাফি–ভক্তরা লিবিয়ায় উদ্যাপন করে থাকেন। ওই দিনটিতে তাঁকে স্মরণ করতে অনেক মানুষ পথে নামে।
এ বছরের উদ্যাপনগুলো বেশ বিশদ পরিসরের ছিল। অন্যবারের তুলনায় এ বছর মানুষের সমাগম অনেক বেশি হয়েছে। সির্তে, বনু ওয়ালিদ, দক্ষিণের সেবহা এবং আরও অনেক গ্রাম ও শহরে বহু মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।অনেক তরুণকে এবারের উৎসবে যোগ দিতে দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশই ছিল শিশু বা কিশোর, যাদের গাদ্দাফির শাসনের সময়ের জীবন কেমন ছিল, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।মূলধারার মিডিয়ায় গাদ্দাফিকে একজন নির্মম স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয়, অচিরেই তাঁর নাম কেউ মনেও রাখবে না। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না।এ বছর বনু ওয়ালিদে বিপ্লব দিবস উদ্যাপনের র্যালিতে গাদ্দাফির মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে গাদ্দাফির মতো পোশাক পরে একটি খোলা জিপে দেখা যায়। তাঁকে ঘিরে জনতার উল্লাস দেখা যায়।লিবিয়ার বিশিষ্ট কবি, গীতিকার এবং সংগীতজ্ঞ আলী আল-কিলানি মনে করেন, গাদ্দাফি ‘মারা যাননি’, কারণ তিনি লিবিয়ার মানুষের মধ্যে সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার ধারণা সৃষ্টি করে গেছেন।
মিসরে নির্বাসিত অবস্থায় থাকা আলী আল কিলানি আমাকে টেলিফোনে বলছিলেন, ‘লিবিয়া আবার শত শত গাদ্দাফি সৃষ্টি করবে, যারা লিবিয়াকে গাদ্দাফির শাসনামলের মতোই স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।’
২০১৪ সাল থেকে লিবিয়া দুটি প্রশাসনে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। একটি ত্রিপোলিতে এবং একটি পূর্বের বেনগাজিতে। এই বিভাজন স্থায়ী রূপ নিতে পারে এবং একসময় একক লিবিয়ার পরিবর্তে দুটি দেশে পরিণত হতে পারে। এখানে বলে রাখি, গাদ্দাফি বিদেশি হস্তক্ষেপ কোনোভাবে বরদাশত করতেন না। এটিও তাঁর মরণোত্তর জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ।এখন এটি স্পষ্ট যে ২০১১ সালের ন্যাটোর হস্তক্ষেপ যদি গাদ্দাফির সবকিছু মুছে ফেলার জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
এই উদ্যাপনগুলো নতুন প্রজন্মের মধ্যে গাদ্দাফির প্রতি একটি বিশেষ আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।
গাদ্দাফির সাবেক সহকারী ও লিবিয়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্লাস্টিক সার্জন মুস্তাফা এলজাইদি মনে করেন, ‘পশ্চিমারা গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি’, তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং এরপর যা-ই ঘটুক, সেটি তাদের কাছে ‘ভালো’। তিনি মনে করেন, লিবিয়ায় এখন যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ এই বিদেশি হস্তক্ষেপ।